আমান খান নামেই পরিচিত, তবে পুরো নাম আমান হাকিম খান। আইপিএলের দিল্লী ক্যাপিটালসের নতুন সেনসেশন। এলাম, খেললাম, জয় করলাম। চলতি আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটাল দলের হয়ে প্রথমবারের মত খেলতে নেমে এমন অভিজ্ঞতাই হল আমান খানের।
পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ দল গুজরাট টাইটানসের সাথে একদম তলানীতে থাকা দিল্লী ক্যাপিটালসের খেলা। টসে জিতে দিল্লীর অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ব্যাটিং নিয়ে বিপাকে পড়লেন। খেলা শুরুর পাঁচ ওভারের মধ্যেই পাঁচ উইকেট নেই। স্কোরবোর্ডে সংগ্রহ মাত্র ২৫ রান।
শীর্ষ ব্যাটারদের প্রায় সবাই পত্রপাঠ ফিরে এসেছেন প্যাভিলিয়নে। গুজরাটের পেসার মোহাম্মাদ শামির তোপে কেউই দাঁড়াতে পারেননি। ক্রিজে তখন ছয় নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নামা অক্ষর প্যাটেল। অন্যপ্রান্তে এলেন আমান হাকিম খান।
গুজরাটের বোলারদের ভয়ংকর বোলিংয়ে মনে হচ্ছিল দিল্লী ক্যাপিটাল সবচেয় অল্প রানে গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জাজনক রেকর্ড গড়বে। গুজরাটের বোলিং লাইন আপে আছে মোহাম্মদ শামি ছাড়াও আইপিএলে চলতি ম্যাচেই শত উইকেট শিকারী মোহিত শর্মা ও জস লিটল। এছাড়া আফগান লেগ স্পিনার রশিদ খানের সাথে তারই স্বদেশী আরেক স্পিনার নুর আহমেদ।
গুজরাট সমর্থকরা আরেকটি সহজ জয়ের আশায় যখন নড়েচড়ে বসেছেন তখনই দেখা গেল দিল্লীর অন্যরূপ। ক্রিকেটের সৌন্দর্য যেখানে লুকিয়ে, পাল্টা আক্রমনে প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত রাখা। সেটাই দেখালেন অক্ষর প্যাটেল আর আমান খান।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারের প্রথম বলে অক্ষর প্যাটেল একরান নিলে ষ্ট্রাইক পান আমান হাকিম খান। নিজের মুখোমুখি হওয়া জস লিটলের প্রথম চার বলে কোন রান নিতে পারেন নি আমান। তবে ষষ্ঠ ওভারের ষষ্ঠ বলে বলকে পাঠান বাউন্ডারি লাইনের বাইরে। চার রান নিয়ে রানের খাতা খুলেন আমান।
অষ্টম ওভারের প্রথম বলেই বড় পরীক্ষার মুখে পড়েন আমান। চ্যাম্পিয়ন লেগ স্পিনার রশিদ খানের মুখোমুখি হন শুরুতেই। একরান নিয়ে অক্ষরকে পাঠান ষ্ট্রাইকে। দ্বিতীয় বলে রান নিতে পারেননি অক্ষর। তৃতীয় বলে অক্ষর প্যাটেল একরান নিলে রশিদের সামনে পড়েন আবার। তবে এবার বিপুল বিক্রমে রশিদকে ছক্কা মেরে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দেন আমান।
সম্ভবত এখান থেকেই পেয়ে যান সাফল্যের প্রয়োজনীয় মটিভেশন। রশিদকে খেলতে বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেটাররাই সমস্যাই পড়েন। সেখানে এক নবিশ আমান খান ছক্কা মারতে পারলে তো দিনটি তারই!
হলোও তাই! অক্ষরের সাথে টি-২০ সুলভ একটি পার্টনারশীপ বা জুটি জমে গেলে আমানের। রশিডের দ্বিতীয় ওভারে অক্ষর প্যাটেলও ছক্কা হাকালেন। রশিদকে আমান ছক্কা মারতে পারলে অক্ষরই বা বাদ যাবেন কেন!
ত্রয়োদশ ওভারের শেষ বলে অক্ষর প্যাটেল ২৭ রানে বিদায় নিলে (৩০ বল, ২ চার, এক ছক্কা) দলের রান সংখ্যা লড়াই করার মত সংগ্রহে নিয়ে যাবার গুরু দায়িত্ব বর্তায় আমান খানের উপর।
ষোলতম ওভারে মোহিত শর্মাকে এক ছক্কা ও চারে রিপাল প্যাটেলকে নিয়ে ১৩ রান তোলে নেন আমান। পরের ওভারে জশ লিটলকে পেয়ে ১৬ রান তোলে নেন দিল্লীর দুই তরুণ তুর্কী। এক চার সহকারে আমান নেন পাঁচ রান, বাকিটা রিপালের।
আঠারতম ওভারে আবারও মোহিত শর্মা বল করতে এলেন। ব্যাটিংয়ে আমান। প্রথম বলে নিলেন দুই রান, পরের বলেই ছক্কা। প্রথম চার বল থেকেই আমান নিলেন ১১ রান। ৪১ বলে আমান তুলে নিলেন আইপিএলে নিজের প্রথম ফিফটি। নিজের ষষ্ঠ মাচে।
উনিশতম ওভারের তৃতীয় বলে রশিদ খানকে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হন আমান। ৪৪ বলের ইনিংসে সমান ৩টি চার ও ছক্কার মারে তার ৫১ রানের সংগ্রহে দিল্লী তুলতে পারে ১৩০ রান।
প্রতিপক্ষের সামনে এটা অল্প রানের টার্গেট হলেও গুজরাট টাইটানস সেটা টপকাতে পারেনি।
হার্দিক পান্ডিয়া আর রশিদ খান উইকেটে থাকা সত্ত্বেও ১২৫ রানে থেমে যায় গুজরাট টাইটানস। শেষ পর্যন্ত সহজ টার্গেটে হাতের মুঠোয় থাকা ২ পয়েন্ট হারাতে হয় তাদের। বলা যায় আমান হাকিম খানের অনমনীয় ব্যাটিংয়ের কাছেই পরাভূত হয় তারা।
কে এই আমান হাকিম খান?
আমান খান বেড়ে উঠেছেন মুম্বাইয়ে। ২৫ বছরের এই তরুণ এবারই প্রথম বারের মত আইপিএলে সুযোগ পেয়েছেন দিল্লী ক্যাপিটালসের হয়ে। তিনি মূলত: একজন অলরাউন্ডার। ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি হার্ড হিটার বা পাওয়ার হিটার ব্যাটার হিসাবেও খ্যাতি আছে তার।
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে আমানের অভিষেক ২০২১ সালে। স্বীকৃত টি-২০তে ২০ ম্যাচে এ পর্যন্ত করেছেন ২৩৮ রান। আর বোলিংয়ে নিয়েছেন চার উইকেট।
এর আগে মেঘা আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স আমানকে নিয়েছিল ২০ লাখ রুপীতে। বয়স ভিত্তিক দলে খেলছেন ভারতীয় তারকা ব্যাটসম্যান শ্রেয়াস আয়ারের সাথে। আমানের বাবাও ক্রিকেট খেলতেন। বাবার ইচ্ছা ছিল আমান বোলার হিসাবেই খেলবেন।
আরও পড়ুন: ২০০তম টি-২০ ম্যাচে ধোনী যেভাবে খেলেছেন
তবে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের একটি ম্যাচ খেলার আগের দিন দুর্ঘটনায় পড়ে কোমর ও পায়ের আঙ্গুলে ব্যথা পান আমান। তাই পরের দিন বোলিং করতে পারেননি। তবে ব্যাটিংয়ে করতে নেমে ৬০ রানের ঝকঝকে একটি ইনিংস উপহার দেন তিনি। সেটা আবার নজরে পড়ে তার কোচ প্রভীন আম্রের, একসময় যিনি নিজেও একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন ভারতীয় জাতীয় দলের।
পরের ম্যাচে প্রভীন আম্রে আমানকে চার নাম্বারে ব্যাট করতে পাঠান। এরপর ওপেনিংয়ে পাঠিয়েও পরীক্ষা করেছেন তাকে। মুম্বাইয়ের অনুর্ধ্ব ১৯ দলে নজর কাড়া নৈপূণ্য প্রদর্শন করে আমান সুযোগ পান কুচবিহার ট্রফিতে তবে ইনজুরির কারনে খেলতে পারেননি।
তবে মুম্বাইয়ের সিনিয়র দলে বিজয় হাজারে ট্রফি ক্রিকেটে সুযোগ পেয়ে সেমিফাইনালে ছয় নাম্বারে নেমে ১৮ বলে ২৫ রানের একটি ক্যামিও উপহার দেন। ফাইনালে দলের হয়ে বোলিংয়ে দুই ওভারে ২২ রান দিয়ে উইকেট শুন্য থাকেন। তবে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়নি তাকে। এর আগেই ট্রফি জিতে নেয় তার দল।
আইপিএলে সুযোগ পাবার আগে আমান ছয় বছর ধরে ট্রায়াল দেন বিভিন্ন দলের হয়ে। তবে ২০১৮ সালে মুম্বাই টি-২০ লীগে ৪৭ বলে ৮৫ রানের একটি বিধ্বংসী ইনিংস খেলে সবার নজর কাড়েন। সেই ম্যাচে শ্রেয়াস আইয়ারের সাথে ১২৭ রানের একটি জুটি গড়ে ছিলেন আমান। এই একটি ইনিংসই তার ক্যারিয়ারে বড় ধরণের উত্তরণে সাহায্য করে।